Top Ad unit 728 × 90

সংবাদ শিরোনাম

recent

যে মস্তিষ্ক হিটলার পয়দা করেছিল

গোলাম মাওলা রনি : পৃথিবীতে সর্বকালেই দুই-চারজন হিটলারজাতীয় প্রাণী ছিল। স্থান কাল পাত্র ভেদে এরা কখনোবা ফেরাউন নাম ধারণ করে আবার কখনো হয়তোবা হামান। চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, হালাকু খানেরা প্রাণী হিসেবে হিটলারজাতীয় লোকদের তুলনায় বেশ খানিকটা উন্নত। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা সময় মতো আরেকদিন করা যাবে। আজ শুধু হিটলার নিয়েই থাকি। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানির ৮৬ বছরের বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট হিল্ডেনবার্গ হিটলারকে চ্যান্সেলর বানিয়ে দিলেন। জার্মানিতে চ্যান্সেলর পদটি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো একটি প্রশাসনিক পদবি। এই ঘটনার ঠিক দেড় বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৩৪ সালের আগস্ট মাসে ফন হিল্ডেনবার্গ মারা যান। হিটলার তখন প্রেসিডেন্ট পদটিও দখল করে ফেললেন। জার্মানির ইতিহাসে একমাত্র হিটলারই একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর উভয় পদ অাঁকড়ে ছিলেন আমৃত্যু। তাকে কি প্রেসিডেন্ট বলা হবে নাকি চ্যান্সেলর এই সমস্যা দূর করার জন্য তিনি নতুন একটি উপাধি গ্রহণ করলেন। তার এই উপাধিটির নাম ছিল ফুয়েবার অর্থাৎ ত্রাণকর্তা।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের শিখানো হতো জার্মান জাতির ফুয়েবার মহামতি হিটলার হলেন দ্বিতীয় যিশুখ্রিস্ট- যিনি কিনা প্রথমজনের চেয়েও বড়। হিটলারের দলের নাম ছিল নাৎসি এবং দলের ভাবাদর্শকে বলা হতো নাৎসিবাদ। দেশের সব দল, ট্রেড ইউনিয়ন এমনকি সামাজিক সংগঠনগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হলো। জার্মানিতে আর কারুরই বাঁচার অধিকার থাকল না কেবল নাৎসি ভাবধারার লোকজন ব্যতিরেকে। শিক্ষা-দীক্ষা, অভিনয়, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে নাৎসিমার্কা ছাপ লাগিয়ে দেওয়া হলো। হিটলারের ছিল বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত কয়েকজন সহচর। এদের মধ্যে একজনের নাম হেরম্যান গোয়েরিং। তিনি বলতেন- বিশুদ্ধ যুক্তি, নীতিকথা, আর নিরপেক্ষ চিন্তার যুগ চলে গেছে। এখন নির্ভেজাল জার্মানরা বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা, প্রজ্ঞা, ধর্মবোধ ইত্যাদি বাদ দিয়ে কেবল রক্ত দিয়ে চিন্তাভাবনা করে। গোয়েরিং ছাড়াও হিটলারের আরেক কুখ্যাত সহযোগী তাবৎ দুনিয়ায় পরিচিত হয়ে উঠেছিল। ডক্টর জোসেফ গোয়েবলসের পদবি ছিল তথ্যমন্ত্রী। তিনি সংবাদপত্র সম্পর্কে বলতেন- মানুষ যেমন পিয়ানো থেকে ইচ্ছামতো সুর বের করে- তেমনি সংবাদপত্রকেও আমার ইচ্ছামতো কথা বলানোই আমার অভিপ্রায়।
আজকের শিরোনাম হলো- যে মস্তিষ্ক হিটলার পয়দা করেছিল, অর্থাৎ যে ব্যক্তির চিন্তাধারা, জ্ঞানবুদ্ধি এবং ভাবধারা দ্বারা হিটলার অনুপ্রাণিত হয়ে নাৎসিবাদ তথা ফ্যাসিবাদ চালু করেছিলেন তার সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করব আজকের এই লেখনির মাধ্যমে। হিটলারের মূলমন্ত্র ছিল- বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা এবং সাধারণ জনগণের মুখ বন্ধ করে নাৎসিবাদের সব কিছু সমর্থন করিয়ে নেওয়া। চ্যান্সেলর নির্বাচিত হওয়ার কিছু দিন পর হিটলার পার্লামেন্টের সব বিরোধীদলীয় এমপিকে গ্রেফতার করে জেলে ভরলেন। ওই দেশে পার্লামেন্টকে বলা হয় রাইখস্টান। রাইখস্টান ভবন অর্থাৎ পার্লামেন্ট ভবনটি কোনো এক রাতে কে বা কারা সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। নাৎসিরা বলল, এই কাজ বিরোধী দল করেছে- ফলে নতুন করে শুরু হলো ধরপাকড়।
১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি সময়জুড়ে পুরো জার্মানিতে শুরু হলো নাৎসিদের ভয়ানক তাণ্ডব। প্রথমেই পার্লামেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হলো। রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা ন্যস্ত করা হলো হিটলার এবং তার মন্ত্রিসভার হাতে। এরা আইন তৈরি করতে পারবেন এবং যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবেন। রাষ্ট্রের সংবিধান বাতিল বলে ঘোষণা করা হলো- গণতন্ত্রের দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হলো। জার্মানিতে তখন পর্যন্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে পরিচালিত সরকারব্যবস্থা। নাৎসিরা এ পদ্ধতি রহিত করে সব ক্ষমতা বার্লিনে এনে কেন্দ্রীভূত করল। প্রত্যেক জায়গাতেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে ডিক্টেটর নিয়োগ করা হলো- যারা কেবল নিজের নিজের ঊর্ধ্বতন ডিক্টেটরের অধীন থাকবে। সর্ব প্রধান ডিক্টেটরের পদটিতে স্বভাবতই বসলেন হিটলার স্বয়ং।
এসব পরিবর্তন ঘটেছিল ঝড়ের গতিতে- অন্যদিকে উল্কার গতিতে পুরো জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ল নাৎসি ঝটিকা বাহিনীর অন্যায় অত্যাচার এবং প্রলয়ংকরী তাণ্ডব। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এই বাহিনী এমন এক আতঙ্ক এবং অত্যাচার শুরু করল যা দেখে মানুষজন বর্বরতা এবং নৃশংসতার নতুন সংজ্ঞা জানল এবং ভয় ও আতঙ্কে একেবারে বোবা পাথর হয়ে গেল। তারা এ কাজ করত কেবল এ কারণে যে, ভিন্ন মতাবলম্বীরা তাদের দলমত ভুলে যেন নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেয়। ভেবেচিন্তে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় এবং অবিশ্বাস্যরকম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তারা এ অভিযান চালাচ্ছিল। যেসব বই নাৎসিদের পছন্দ নয় তা যেমন ধ্বংস করা হচ্ছিল তেমনি পুরো সংবাদপত্র শিল্পকে গলাটিপে ধরা হয়েছিল নিদারুণভাবে। অতি সামান্য মতভেদ বা সমালোচনার অপরাধে বহু সংবাদপত্রকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। নাৎসি অত্যাচারের কোনো সংবাদই কাগজে প্রকাশ করতে দেওয়া হতো না, এমনকি এ সম্বন্ধে কেউ কানাঘুষা করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো।
নাৎসিদের এতসব কর্মকাণ্ডের পেছনে ছিল অন্তত একটি নীতি- বল প্রয়োগের নীতি। অপরের প্রতি বল প্রয়োগ এবং উৎপীড়নকে এরা শুধু প্রশংসা এবং উৎসাহ প্রদানই করত না- তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য বলে মনে করত। এই দর্শনের জনকের নাম অস্ভাল্ড স্পেংলার। লোকটি সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের মধ্যে অন্যতম এবং তিনিই হলেন নাৎসি জাতির রূহানী পিতা। তার মন-মস্তিষ্ক এবং চিন্তাধারার কারণেই দুনিয়াতে হিটলার এবং নাৎসিবাদের পয়দা হয়েছিল।
তিনি যেসব বই লিখেছেন তাতে যে প্রচুর পরিমাণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় আছে তা দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। অথচ সেই অগাধ পাণ্ডিত্য নিয়েও তিনি উপনীত হয়েছেন অদ্ভুত এবং ঘৃণ্য সব সিদ্ধান্তে। তিনি বলেন- ‘মানষ হচ্ছে একটি শিকারি পশু, সাহসী, ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর।’ ‘আদর্শবাদ মানেই কাপুরুষতা’- ‘শিকারি জন্তুই হচ্ছে জীবন্ত প্রাণশক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তার ভাষায় ‘সহানুভূতি আপস স্থাপন এবং শান্তি হচ্ছে দন্তহীন অনুভূতি।’ ‘ঘৃণা হলো শিকারি পশুর সবচেয়ে খাঁটি জাতিগত চেতনা’ মানুষকে হতে হবে সিংহের মতো- তার গর্তে তার সমান শক্তিশালী আর একজনের অস্তিত্ব সে কিছুতেই বরদাস্ত করবে না। শান্তসিষ্ট গরু পালে মিশে থাকে এবং যেদিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাও সেই দিকেই চলে। কাজেই মানুষকে গরুর মতো হলে চলবে না। সিংহসম মানুষের পক্ষে যুদ্ধই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ এবং আনন্দ।
সম্মানিত পাঠক, এবার নিশ্চয়ই অস্ভাল্ড স্পেংলার নামক অদ্ভুত পণ্ডিত এবং দার্শনিক লোকটি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারেন। তিনি জার্মানিতে জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালে এবং মারা গিয়েছেলেন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৩৬ সালের ৮ মে। তার লেখা ভুবন বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ ডিব্রাইন অব দি ওয়েস্ট বইটি এখনো পাঠকমহলে সমাদৃত। প্রথম মহাযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি সম্ভবত এক ধরনের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে নাৎসিবাদ পয়দা হলেও তিনি কিন্তু ঘোর নাৎসিবিরোধী ছিলেন। জোসেফ গোয়েবলস বার বার ধরনা ধরেও সোংলারকে নাৎসি সমর্থক বানাতে পারেননি। এ যেন অনেকটা বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেস্টাইন এবং তার সৃষ্ট দানবের কাহিনীর মতো।
দানব যেভাবে বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেস্টাইনকে মেরেছিল নাৎসিরা কিন্তু ওভাবে স্পেংলারকে মারেনি। বরং যথেষ্ট তাজিম সহকারে তাকে সমীহ করত এবং তাদের ধর্মগুরু হিসেবে অনেকটা উপযাচক হয়ে তার সঙ্গে খায়খাতির করত। স্পেংলার ওসব পাত্তা দিতেন না। বরং জার্মানসহ পুরো ইউরোপে নাৎসিদের বিস্ময়কর উত্থান এবং পাশবিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড মমপীড়া অনুভব করতেন। ফলে অতি অল্প বয়সেই তিনি তার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে মিউনিখে বসবাস শুরু করেন। এই সময় তিনি বিখ্যাত জার্মান সংগীতজ্ঞ বিটোফেনের গীত শুনতেন, ফরাসি সাহিত্যিক নাট্যকার মলিয়িরের রম্য রচনা এবং শেকসপিয়রের রচনাসমূহ পাঠ করতেন।
বাজার থেকে হাজার হাজার বই কিনে লাইব্রেরি বানাতেন, তুরস্ক, পারস্য এবং হিন্দুস্তানের প্রাচীন যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করতেন। মাঝে মধ্যে সুউচ্চ হার্জ পর্বতামালার শিখরে উঠতেন এবং ইতালিতে ভ্রমণ করতেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে কোন এক বসন্ত দিনে তিনি তার এক প্রিয় শিষ্যকে চিঠি লিখলেন। শিষ্যটি তখন জার্মানির জাতীয় নেতা এবং হিটলারের অতীব কাছের মানুষ। হ্যানস ফ্রাঙ্ক নামের শিষ্যটি একদিকে যেমন ছিলেন নাৎসি পার্টির বড় নেতা অন্যদিকে হিটলারের ব্যক্তিগত আইনজীবী।
তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মানির চিফ জুরিস্ট এবং অধিকৃত পোল্যান্ডের জেনারেল গভর্নমেন্ট ছিলেন। স্পেংলার লিখলেন- ‘আগামী ১০ বছর পর জার্মানি নামের বর্তমান রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব হয়তো থাকবে না। তিনি মারা গেলেন ১৯৩৬ সালের ৮ মে- ঠিক তার ৫৬ তম জন্মদিনের তিন সপ্তাহ আগে এবং জার্মানির পতনের ঠিক নয় বছর আগে।
যে মস্তিষ্ক হিটলার পয়দা করেছিল Reviewed by sohel on July 06, 2015 Rating: 5
প্রকাশক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ সোহেল রানা শাখারিয়া (কদিম পাড়া বাজার) বগুড়া । ফোন: +৬০১৭৮৪৭১১৬১ ইমেইল: bogracity7274@gmail.com : বগুড়া টাইমস সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2014 - 2019
,

নিউজ ২৪ বগুড়া

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.